হলুদ পোড়া গল্পের নামকরণের সার্থকতা || দ্বাদশ শ্রেণী || ফোর্থ সেমিস্টার
![]() |
হলুদ পোড়া গল্পের নামকরণ সার্থকতা
দ্বাদশ শ্রেণী বাংলাউত্তর: যে-কোনো সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে নামকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রচয়িতা নামকরণের মাধ্যমে বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেন এবং পাঠকবর্গকে তাঁর সৃষ্টির রসাস্বাদনে আগ্রহী করে তোলেন। এই নামকরণ লেখকবৃন্দ নানান উদ্দেশ্য নিয়ে করে থাকেন, যেমন-চরিত্রকেন্দ্রিক, কাহিনিকেন্দ্রিক, কোনো বিশেষ বার্তাকেন্দ্রিক কিংবা ভাব ব্যঞ্জনার্থে। এখন আলোচনা করে দেখা যাক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'হলুদ পোড়া' গল্পটির নামকরণটি কোন্ আঙ্গিকে কতখানি সার্থক হয়েছে।
মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে খুব নাটকীয়ভাবে গল্পের শুরু। ঘটনাটি যে বছরের সে বছর কার্তিকে তিন দিন আগে-পরে গাঁয়ে দু-দুটো খুন হয়ে যায়—একজন মাঝবয়সী জোয়ান পুরুষ এবং অপরজন ষোলো-সতেরো বছরের একটি রোগা ভীরু মেয়ে। প্রথমে বলাই চক্রবর্তী, তার তিন দিন পরে খুন হয় শুভ্রা। গাঁয়ে এই নিয়ে শুরু হয় গালগল্প। দুটো খুনের মধ্যে একটা কাল্পনিক সংযোগ ঘটিয়ে নানা রসাল মুখেমুখে ফিরতে থাকে। এই রহস্য নিয়ে সকলের ব্যস্ততার মাঝে বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনী এক সন্ধ্যাতে উঠোনে আছড়ে পড়ে এবং দাঁতে দাঁত লেগে যায়। গ্রামের মুরুব্বি পঙ্কজ ঘোষাল তার চিকিৎসার জন্য ওঝা কুঞ্জ মাঝিকে ডাকতে বলেন, অন্যদিকে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ও শখের ডাক্তার ধীরেন নবীনকে পরামর্শ দেয় কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকতে। কিন্তু কৈলাশ ডাক্তার আসার আগেই কুঞ্জ এসে দামিনীর শরীরের মধ্যে থাকা অশরীরীকে দমন করতে বা তাড়াতে আয়োজন শুরু করে। মানসিক ও দৈহিক পীড়নের একটা পর্যায়ে এসে মালসায় আগুন করে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনীর নাকের কাছে ধরলে তার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের হয়
যে, সে শুভ্রা এবং বলাইখুড়ো তাকে হত্যা করেছে। দামিনীর এই স্বীকারোক্তি মানুষের মনে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—মানুষের মনে যেন হলুদ পোড়ার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পায়। অনেক কান ঘুরে কথাগুলো শুভ্রার দাদা ধীরেনের কানে যায়। শুভ্রার মৃত্যুরহস্য তার মনে বীকার সৃষ্টি করে। বাড়িতেও কেমন যেন ভৌতিক আবহ। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে যে, ছোটোপিসি ভূত হয়েছে। ঘরের মধ্যেও কারণে-অকারণে স্ত্রী শান্তি ভয়ে আঁতকে ওঠে। রাত্রিবেলা উঠোনে পোড়া বাঁশ পেতে রাখে যাতে কোনো অশরীরী আত্মা তা ডিঙিয়ে বাড়ির লোকের ক্ষতি না-করে। এইরূপ পরিস্থিতিতে একদিন সন্ধ্যাতে মৃত শুভ্রার আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর পেতে রাখা পোড়া বাঁশ ডিঙিয়ে চোরের মতো ধীরেন পা টিপেটিপে ডোবার মাঠের দিকে চলে যায়। সেখান থেকে সে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ফেরে, বাঁশ ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে চায়, কিন্তু পারে না। আবার কুঞ্জ ওঝার আগমন ঘটে তার ভূত ছাড়াতে। কুঞ্জু মন্ত্র পড়ে, জল ছিটিয়ে, আগুনে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরে। আবারও যেন হলুদ পোড়ার গন্ধেই অশরীরী বশ মানে এবং সবাই শুনতে পায়— ধীরেন বলে সে বলাই চক্রবর্তী, শুভ্রাকে সে খুন করেছে।
যুক্তিবাদী বিজ্ঞান-পড়া মনকেও একটা ভৌতিক কুসংস্কার যে আচ্ছন্ন করতে পারে তা লেখক এই গল্পে ব্যঞ্জনার দ্বারা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।
গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর কাহিনি চুম্বকের মতো পাঠক মনকে আকর্ষণ করেছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে। লেখক মধ্যবিত্ত মননের কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাকে তার। অবচেতন মন থেকে তুলে আনার জন্যই যেন এই কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে অশরীরীর ভাষা শুনতে পাওয়ার সেতু তৈরি করেছেন, অর্থাৎ কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনী ও ধীরেনের নাকে শোঁকানোর মধ্য দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের নানান অলৌকিক ঘটনা সামনে এসেছে এবং সমাজ তা প্রত্যক্ষ করেছে, একইসঙ্গে তার সামনে বিচারবিশ্লেষণ করার সুযোগও এসেছে। এসব বিচার-বিবেচনা করে।দেখলে এটা স্পষ্ট যে লেখকের ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণের দিক থেকে গল্পটির নামকরণ যথার্থ ও সার্থক। তা ছাড়া 'হলুদ' হল মুক্ত ও আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রতীক। যাকে পোড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্ত ও আধুনিক চিন্তাভাবনাকেই যেন ধ্বংস করা হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইটাই ছিল এসরে বিরুদ্ধে—এসব দৃষ্টিকোণ থেকেও নামকরণের সার্থকতাকে সমর্থন করাই যায়।
মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে খুব নাটকীয়ভাবে গল্পের শুরু। ঘটনাটি যে বছরের সে বছর কার্তিকে তিন দিন আগে-পরে গাঁয়ে দু-দুটো খুন হয়ে যায়—একজন মাঝবয়সী জোয়ান পুরুষ এবং অপরজন ষোলো-সতেরো বছরের একটি রোগা ভীরু মেয়ে। প্রথমে বলাই চক্রবর্তী, তার তিন দিন পরে খুন হয় শুভ্রা। গাঁয়ে এই নিয়ে শুরু হয় গালগল্প। দুটো খুনের মধ্যে একটা কাল্পনিক সংযোগ ঘটিয়ে নানা রসাল মুখেমুখে ফিরতে থাকে। এই রহস্য নিয়ে সকলের ব্যস্ততার মাঝে বলাই চক্রবর্তীর ভাইপো নবীনের স্ত্রী দামিনী এক সন্ধ্যাতে উঠোনে আছড়ে পড়ে এবং দাঁতে দাঁত লেগে যায়। গ্রামের মুরুব্বি পঙ্কজ ঘোষাল তার চিকিৎসার জন্য ওঝা কুঞ্জ মাঝিকে ডাকতে বলেন, অন্যদিকে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক ও শখের ডাক্তার ধীরেন নবীনকে পরামর্শ দেয় কৈলাশ ডাক্তারকে ডাকতে। কিন্তু কৈলাশ ডাক্তার আসার আগেই কুঞ্জ এসে দামিনীর শরীরের মধ্যে থাকা অশরীরীকে দমন করতে বা তাড়াতে আয়োজন শুরু করে। মানসিক ও দৈহিক পীড়নের একটা পর্যায়ে এসে মালসায় আগুন করে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনীর নাকের কাছে ধরলে তার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের হয়
যে, সে শুভ্রা এবং বলাইখুড়ো তাকে হত্যা করেছে। দামিনীর এই স্বীকারোক্তি মানুষের মনে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—মানুষের মনে যেন হলুদ পোড়ার মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা পায়। অনেক কান ঘুরে কথাগুলো শুভ্রার দাদা ধীরেনের কানে যায়। শুভ্রার মৃত্যুরহস্য তার মনে বীকার সৃষ্টি করে। বাড়িতেও কেমন যেন ভৌতিক আবহ। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে যে, ছোটোপিসি ভূত হয়েছে। ঘরের মধ্যেও কারণে-অকারণে স্ত্রী শান্তি ভয়ে আঁতকে ওঠে। রাত্রিবেলা উঠোনে পোড়া বাঁশ পেতে রাখে যাতে কোনো অশরীরী আত্মা তা ডিঙিয়ে বাড়ির লোকের ক্ষতি না-করে। এইরূপ পরিস্থিতিতে একদিন সন্ধ্যাতে মৃত শুভ্রার আত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর পেতে রাখা পোড়া বাঁশ ডিঙিয়ে চোরের মতো ধীরেন পা টিপেটিপে ডোবার মাঠের দিকে চলে যায়। সেখান থেকে সে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ফেরে, বাঁশ ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে চায়, কিন্তু পারে না। আবার কুঞ্জ ওঝার আগমন ঘটে তার ভূত ছাড়াতে। কুঞ্জু মন্ত্র পড়ে, জল ছিটিয়ে, আগুনে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরে। আবারও যেন হলুদ পোড়ার গন্ধেই অশরীরী বশ মানে এবং সবাই শুনতে পায়— ধীরেন বলে সে বলাই চক্রবর্তী, শুভ্রাকে সে খুন করেছে।
যুক্তিবাদী বিজ্ঞান-পড়া মনকেও একটা ভৌতিক কুসংস্কার যে আচ্ছন্ন করতে পারে তা লেখক এই গল্পে ব্যঞ্জনার দ্বারা পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।
গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এর কাহিনি চুম্বকের মতো পাঠক মনকে আকর্ষণ করেছে, নিয়ন্ত্রণ করেছে। লেখক মধ্যবিত্ত মননের কুসংস্কারাচ্ছন্ন তাকে তার। অবচেতন মন থেকে তুলে আনার জন্যই যেন এই কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে অশরীরীর ভাষা শুনতে পাওয়ার সেতু তৈরি করেছেন, অর্থাৎ কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে দামিনী ও ধীরেনের নাকে শোঁকানোর মধ্য দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের নানান অলৌকিক ঘটনা সামনে এসেছে এবং সমাজ তা প্রত্যক্ষ করেছে, একইসঙ্গে তার সামনে বিচারবিশ্লেষণ করার সুযোগও এসেছে। এসব বিচার-বিবেচনা করে।দেখলে এটা স্পষ্ট যে লেখকের ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণের দিক থেকে গল্পটির নামকরণ যথার্থ ও সার্থক। তা ছাড়া 'হলুদ' হল মুক্ত ও আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রতীক। যাকে পোড়ানোর মধ্য দিয়ে মুক্ত ও আধুনিক চিন্তাভাবনাকেই যেন ধ্বংস করা হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইটাই ছিল এসরে বিরুদ্ধে—এসব দৃষ্টিকোণ থেকেও নামকরণের সার্থকতাকে সমর্থন করাই যায়।
